প্রকাশিত: Mon, Jun 3, 2024 3:01 PM
আপডেট: Tue, Apr 29, 2025 11:53 PM

দুই বাংলার বিভক্তি আসলে ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক

শামসুদ্দিন পেয়ারা 

বাঙলা তো এক ছিল, একই আছে। বিভাগটা রাজনৈতিক। ধর্মীয় নয়। আরো পিনপয়েন্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, মেজরিটি ও মাইনরিটির বিভাগ। সে মেজরিটি ও মাইনরিটি যদিও ধর্মেরই। হিন্দু ও মুসলমানের। এই বাঙলায় মুসলিম মেজরিটি, তাই মুসলমানরা এখানে দাপট দেখায়। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবাদিতে হিন্দুরা একটু সরে সরে থাকে। আবার ঐ বাঙলায় পরিস্থিতি ভিন্ন, সেখানে হিন্দু মেজরিটি, তাই হিন্দুরা ওখানে দাপট দেখায়। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবাদিতে মুসলমানরা একটু সরে সরে থাকে। দৃশ্যত ধর্মীয় মনে হলেও বিরোধটা প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় নয়, সাম্প্রদায়িক। ধর্মের নাম করে, ধর্মীয় সংখ্যাধিক্যের (মেজরিটির) দাপট দেখিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে করিয়ে দেয়া যে ধর্মানুসারীদের সংখ্যার বিচারে আমরা কিন্তু তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি। আমরাই সেরা। আমাদের ধর্ম তোমাদের ধর্মের চেয়ে অনেক উপরে। এটা ধর্মীয় সংকীর্ণতাক্রান্ত অতিশয় নিচু ও অশিক্ষা-কুশিক্ষাগ্রস্ত একটি দরিদ্র সমাজের চিত্র তুলে ধরে।

মেজরিটি কোনো ধর্ম নয়, মেজরিটি হচ্ছে রাজনীতি। দুই বাঙলার কোন অংশে কে বেশি দাপট দেখাবে তা নিয়ে দুই ধর্মের নিচু স্তরের বাজে লোকদের রোয়াব (চট্টগ্রামের ভাষায় সেয়ানামি) দেখানোর কসরৎ। তা না হলে ওপারে যেমন কয়েক কোটি মুসলিম বাঙালি রয়েছে, এপারেও রয়েছে কয়েক কোটি হিন্দু বাঙালি। আগেও এরা ছিল, আগামিতেও থাকবে। দুই  বাঙলার বিভক্তি অনেকটাই জমির আইল নিয়ে পারিবারিক বিরোধের মতো। ১৯৪৭-এ নানা কারণে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল বলে রাগারাগি, ভুল বুঝাবুঝি ও অন্যের উস্কানিতে দাঙ্গাহাঙ্গামা করে দু'জন আলাদা হয়ে গেছে। ওটা হয়ই। এখন দুজনেই বুঝতে পারছে, লাভ কিছু হয়নি। দুজনেই দুকোনায় পড়ে আছে। কেউ তেমন পোছে না। বাঙালির যে গৌরব ছিল তা আজ ধূলিসাৎ। বাঙালির পারস্পরিক বিরোধ মিটাতে হবে। বাঙালিকে তার ধর্মীয় সংকীর্ণতা গোঁড়ামি ভণ্ডামি ও সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতা পরিহার করে একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হবে, যার ভয়ে ভীত তুমি, সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে, যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে। অন্ন চাই প্রাণ চাই আলো চাই/ চাই মূক্তবায়ু/ চাই বল চাই স্বাস্থ্য/ আনন্দউজ্জ্বল পরমায়ু/ সাহস বিস্তৃত বক্ষপট, এ দৈন্য মাঝারে কবি স্বর্গ হতে নিয়ে এসো বিশ্বাসের ছবি।

আবার আমাদের সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে যা আমরা সাম্প্রদায়িকতার কাদামাটিতে হারিয়ে এসেছি ১৯৪৭ সালে।  র‌্যাডক্লিফের আঁকা মিথ্যা ও অলীক সীমান্ত রেখা পার হবার সময় দাঙ্গা বিক্ষুব্ধ ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে বিশ্বাস ও স্বপ্নকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতাস্পৃহা, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে যদি সে বিশ্বাস ও স্বপ্নকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে বাঙলার মাটি জল বাঙলার ফুল ফল তবেই আবার পূণ্য হয়ে উঠবে। একদিন তা হবেই। লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র সাংবাদিক